
২০১০ সালে আপীল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার ৪ বছরের মাথায় আইন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী পদে জেকে বসেন এডভোকেট আনিসুল হক, অথচ এর আগে তিনি এক দিনের জন্য আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী ছিলেন না– যেন আলাদীনের চেরাগ লাভ! কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলার প্রসিকিউটর হওয়া এবং এডভোকেট সিরাজুল হকের সন্তান এই যোগ্যতায় ২০১৪ সালে বিনাভোটে সংসদ সদস্য হয়ে ৭ জানুয়ারীতে আইনমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। বছরের পর বছর মামলা হামলার শিকার শত শত সিনিয়র আওয়ামী আইনজীবীরা এই রকেট গতিতে এমপি মন্ত্রী হওয়ায় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেন আর আক্ষেপ করেন।

এরপর থেকে দূর্দান্ত গতিতে শুরু হয় মন্ত্রী আনিসের দুর্নীতি, অপরাধ ও লাম্পট্যের জয়যাত্রা। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীর অধস্তন আদালতে যতো নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশেই খাতা পরিবর্তন, জালিয়াতি, পরীক্ষা না দিয়েও চাকুরী হওয়ার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুস বানিজ্য সহ পাহাড়সম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সরাসরি আইনমন্ত্রী আনিছুল হকের নির্দেশে সাবেক সচিব (মৃত) জহুরুল হক দুলাল ও বর্তমান সচিব গোলাম সারোয়ারের তত্ত্বাবধানে।
মন্ত্রী আনিসুল তার ক্ষমতা খাটিয়ে ব্রাহ্মবাড়িয়ার সন্তান তার চরম অনুগত গোলাম সারোয়ারকে সচিব পদে বসিয়েছেন আইনবহির্ভুতভাবে, অতঃপর নির্বিঘ্নে চালিয়েছেন দুর্নীতির রামরাজত্ব। গোলাম সারোয়ারও জী হুজুর মার্কা যোগ্যতার। সারোয়ারের সততার ভাণ ধরে আইজিআর অফিস সহ বিভিন্ন অধস্তন দপ্তরে আর্থিক বড় লেনদেনের খাতগুলো থেকে নিয়মিত বিপুল অংকের টাকার ভাগ পান এবং মুখোশের আড়ালে নিয়মিত বিপুল অংকের মাসোহারা নিতেন
আনিসুল তার প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধস্তন আদালতের নিয়োগ কমিটিকে বাধ্য করে সারা বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলা উপজেলায় চতূর্থ শ্রেনীর পদে প্রায় দুই হাজারের মতো কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন কেবলমাত্র নিজের একটি উপজেলা কসবা থেকে। অথচ বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ও সরকারী চাকুরী সংক্রান্ত নিয়োগ বিধিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, চতূর্থ শ্রেনীর চাকুরীতে নিয়োগে প্রাধান্য পাবে স্থানীয় জেলার আবেদনকারীরা। অথচ আইনমন্ত্রী ও তার অনুগত আইন সচিব এই বিধান লংঘন করে বিভিন্ন জেলায় বিপুল সংখ্যক নিয়োগ দিয়েছেন ব্রাহ্মবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বাসিন্দাদের। অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করে বহু বিচারককে অপরাধকর্মে জড়াতে বাধ্য করেছে খোদ আইনমন্ত্রী ও সচিব।
লক্ষনীয়, দেশের প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জ থেকেও এত নিয়োগ পায়নি সারা দেশে, এমনকি ছাত্রলীগ যুবলীগেরও ভাগে তেমন কিছু জোটেনি। আওয়ামী রাজনীতি না করা আইনমন্ত্রী গোপালগঞ্জ পছন্দ করেন না, উল্টো কসবার অনেক বিএনপি-জামাত কর্মী নিয়োগ পেয়েছে মন্ত্রীর বদৌলতে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই কসবা উপজেলার বাসিন্দা নিয়োগ পেয়েছে ৩৪ জন। এরমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৪ জন, মহানগর দায়রা জজ আদালতে ৪ জন, সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনাল ১ জন, নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে ১২ জন, সিএমএম কোর্টে ৩ জন কসবা উপজেলার। এভাবে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খুলনা, রাজশাহী সহ সারাদেশে অধস্তন আদালতে মোট কর্মরত কর্মচারীদের প্রায় এক চতূর্থাংশই কসবা উপজেলার।
সারা দেশের প্রত্যেক জেলায় কসবার নিয়োগপ্রাপ্তদের নাম ও সংখ্যা উল্লেখ করা হলে এই রিপোর্ট বিশাল সাইজের হয়ে যাবে। স্থানীয় এখতিয়ারের বাইরে ঘুষ, দূর্নীতি, সহ আইন লংঘন করে জোর করে দেয়া এসকল নিয়োগ আইনত অবৈধ৷ যথাযথভাবে এই নিয়োগ আইনী চ্যালেঞ্জ করা হলে অনেকাংশ নিয়োগই অবৈধ হয়ে যেতে পারে।
সাদাসিধা ভাব ধরে থাকা মন্ত্রী আনিসুল ও তার সচিব নিয়োগ দুর্নীতি করেই কামিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। একই সাথে আইন মন্ত্রণালয়ের রেজিষ্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট যেন মন্ত্রী সচিবের টাকার খনি। গুলশানের সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার রমজান খান
বাড়ীও ব্রাহ্মবাড়িয়ায় যিনি গুলশান এলাকার একটি দলিল করতে ১ কোটি থেকে ৩/৪ কোটি টাকাও নেন। ঢাকার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাবেকুন ঢাকার বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বস্তা বস্তা টাকা কালেকশন করে তুলে দেন মন্ত্রী ও সচিবকে।
আইনমন্ত্রীর মা জাহানারা হক জীবদ্দশায় দৃশ্যমান কোন আয়ের বৃহৎ উৎস না থাকলেও আলাদীনের চেরাগ বলে হয়ে গেছেন সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কেবলমাত্র তার পুত্রের টাকার খনির বদৌলতে। এর আগে কোনো আইনমন্ত্রীই কখনই কোনো ব্যাংকের মালিক ছিলেন না।
আইনমন্ত্রী-সচিবের দূর্নীতির খতিয়ান টান দিলে বহু আগেই তাদের জায়গা হতো জেলখানায়, অথচ তারা এখনও বহাল তবিয়তে আইন ও বিচার বিভাগ কুক্ষিগত করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অবাক করা বিষয় হলো আইনমন্ত্রী ও সচিবের চক্ষুশুল হলো গোপালগঞ্জ এবং আওয়ামীলীগ। ২/৪ জন ব্যক্তি ছাড়া গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরে বাড়ী এমন কেউ তার মন্ত্রণালয় বা ঢাকায় পোস্টিংয়ে ঢুকতে পারেনা আইনমন্ত্রী-সচিবের সিন্ডিকেট এর কারণে। খোদ সচিব এক সময় মাদ্রাসায় পড়তো, শিবির করতো এবং সময় বুঝে ভোল পাল্টেছে, এমন কথা জনশ্রুতি আছে।
মন্ত্রী আনিসুলের স্ত্রী মারা গেছে বহু বৎসর আগে। এরপর তিনি আর বিবাহ করেননি এটা দেখিয়ে তিনি নিজের সরলতা প্রকাশ করেন, অথচ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম মন্ত্রী আনিসুলের বান্ধবী পরিচয় দিলেও আইন ও বিচার বিভাগে তিনি মন্ত্রীর আন-রেজিস্টার্ড স্ত্রী এবং মূর্তিমান আতংক হিসাবে সবাই তাকে চিনে এবং সমীহ করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে তদবীর, চাপ প্রয়োগ করে জামিন, ইচ্ছামত রায় নেয়া প্রায় সবই সম্ভব মন্ত্রীর এই আনরেজিস্টার্ড স্ত্রীর মাধ্যমে। কাবিননামা অনুসারে এ্যাডভোকেট তৌফিকা ব্যবসায়ী আফতাব-উল ইসলাম মঞ্জুর স্ত্রী। কিন্তু মঞ্জুর সাথে তার কাগজের সম্পর্ক ছাড়া বাস্তবে কোন সম্পর্কই নেই, বরং মন্ত্রী আনিস হলো তৌফিকার সবকিছু- কাবিনবিহীন স্বামী!
বিচার বিভাগে যেকোন তদবীরে মন্ত্রীর প্রভাব ও বিপুল অংকের টাকা দিয়ে ইচ্ছামতো রায় করানোর সবচেয়ে কার্যকর সিন্ডিকেট হলো তৌফিকা চ্যানেল। শত শত কোটি টাকা লেনদেনও এদের কাছে ডাল ভাতের মতো। আনিস-তৌফিকা সিন্ডিকেট সহ আরো কয়েকজন উচ্চ প্রভাবশালী মিলে বসুন্ধরার এমডি আনভীর কতৃক মুনিয়া হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সিটিজেন ব্যাংকে মন্ত্রী আনিস চেয়ারম্যান আর পরিচালক বানিয়েছেন তৌফিকাকে, আর বর্তমানে এই তৌফিকাই হলো ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। অথচ তিনি আইনমন্ত্রী না হলে এই সাধারণ মানের আইনজীবীর ভাল লাইফ-স্টাইল মেনটেইন করার খরচ যোগানও অসম্ভব ছিল। তার পরিচালক হওয়ার টাকার বৈধ উৎস ওকালতি এটা অসম্ভব প্রায়। বসুন্ধরার মামলায় শত শত কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে ইচ্ছামত রায় দেয়ানোর অভিযোগের আঙ্গুল খোদ আইনমন্ত্রী ও তৌফিকার দিকে। শুধু তৌফিকাই নয়, অধীনস্ত একাধিক নারীর সাথে মন্ত্রী আনিসুলের গোপন সম্পর্ক ও কেলেঙ্কারীর কথা মন্ত্রণালয়ে সবার মুখে মুখে।
একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন করলে মন্ত্রীর নিয়োগ বানিজ্য ঘুষ ও তদবীর বানিজ্য, নারী কেলেংকারীর সকল তথ্য অতি সহজে বেরিয়ে আসবে এবং আইন মন্ত্রণালয়ে আইনের প্রয়োগ করা হলে মন্ত্রী সচিবের জায়গা হতো জেলখানায়। সচিব সারোয়ারের সকাল শুরু হয় বিভিন্ন আদালতে ফোন করে মামলার তদবীর করার মধ্য দিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ছোট ভাই আরিফুল হকের কাছে মন্ত্রী আনিসুল পাচার করেছিলেন দুর্নীতিলব্ধ শত শত কোটি টাকা। আরিফের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান আমেরিকাতেই বসবাস করে। সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার পর আনিছুল হক তার দুর্নীতির সম্পদগুলো ম্যানেজমেন্ট করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বলে শোনা যায়। মার্কিন সেংশানে তার নাম ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, আর সেক্ষেত্রে পাচার করা অর্থ বাজেয়োপ্ত হওয়ার দুঃচিন্তায় আছেন মন্ত্রী বাহাদুর।
মন্ত্রী আনিসুলের দুর্নীতির সুস্পষ্ট কিছু ডকুমেন্ট অত্র প্রতিবেদকের হস্তগত হলেও তা বিচারাধীন মামলার অংশ বিধায় প্রকাশ করা হলো না। তবে আইনমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে কেউ মামলা না করলেও এসকল নিয়োগ বানিজ্যের ঘটনায় একাধিক রীট ও ফৌজদারি মামলা হয়েছে। মন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে রীটের খারিজ করিয়েছেন। আইনমন্ত্রীর নিয়োগ বানিজ্য নিয়ে যে ফৌজদারি মামলা হয়েছে, তার ক্ষমতার অবসান হওয়ার পরে অজ্ঞাতনামা আসামীর জায়গায় মন্ত্রী আনিসুলের নাম ও তার মোবাইল কলের রেকর্ড যোগ হবে, এমনটা ধারণা করেন চাকুরী বঞ্চিতরা।
প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর একজন মন্ত্রী, যার সরাসরি ভিকটিম আওয়ামীলীগ। মন্ত্রী হওয়ার আগে একদিনও ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামীলীগ করেনি, অথচ তিনি আইনের মন্ত্রী হয়েও দুর্নীতির মাধ্যমে তার নিজ এলাকার হাজার হাজার লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন সারা বাংলাদেশে অবৈধ ভাবে। এটা করেছেন তিনি আইন লংঘন করে ও ক্ষমতার চরম অপপ্রয়োগ করে।
খোদ শেখ হাসিনার নিজের উপজেলা টুঙ্গিপাড়া, অথচ টুঙ্গিপাড়া উপজেলা থেকে কোনো এক ডিপার্টমেন্টে দুই হাজার লোকেরও চাকুরী হয়নি। এমনকি অন্য কোনো মন্ত্রীর এলাকা থেকেও এমন আজীব নিয়োগ হয়নি। বান্ধবী তৌফিকার বদৌলতে আনিসুল সাহেব বিএনপি জামায়াত বা অন্য দলের ক্যান্ডিডেটের উপর সদয় ছিলেন, এমন খবরের পরে আওয়ামী লীগ দাবী করতে পারে, তারা বঞ্চিত হয়েছে।
কার্যত প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর মন্ত্রী এবং তার কর্মকান্ডের সরাসরি ভিকটিম আওয়ামীলীগ। মন্ত্রী হওয়ার আগে একদিনও ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামীলীগ করেনি তাই ছাত্রলীগ, যুবলীগের প্রতি তার কোন টান নেই। খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের উপজেলা টুঙ্গিপাড়া থেকেও কোনো এক ডিপার্টমেন্টে ১ হাজার লোকেরও চাকুরী হয়নি। এমনকি অন্য কোনো মন্ত্রীর এলাকা থেকেও এমন আজীব নিয়োগ হয়নি। অথচ আনিসুল একাই তার কসবা উপজেলা থেকে অধস্তন আদালতে নিয়োগ দিয়েছে প্রায় দুই হাজার জনকে।
বান্ধবী তৌফিকার পরিবার বিএনপি ঘরনার হওয়ায় তার বদৌলতে আনিসুল সাহেব বিএনপি জামায়াত বা অন্য দলের ক্যান্ডিডেটের উপর খানিকটা সদয় ছিলেন, এমন খবরের পরে অন্যান্য জেলার আওয়ামী লীগ করা লোকজন আইন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার হাহাকার করাই স্বাভাবিক।
মদারু আনিসুলের দুর্নীতি এবং লাম্পট্যে হাতেখড়ি তার পিতা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের হাতে। সিরাজুল হক ছিলেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্টজন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কৌসুলী, আওয়ামীলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম মেম্বার, ৩রা নভেম্বর জেলহত্যা মামলা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলী। ফলে সরকারের উপর তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক।
কোনো মন্ত্রী সচিব তাঁর অনুরোধ ফেলতে পারত না। এক ঘটনায় ২০০১ সালের মে মাসে আ’লীগ সরকারের শেষ সময়ে বাংলাদেশ বিমানের রক্ষণাবেক্ষন কাজ অন্য কোম্পানীর কাছে চলে গেলে পূণরায় কাজ পেতে এয়ার ফ্রান্স কোম্পানী স্থানীয় প্রতিনিধি কাজী তাজুল ইসলাম ফারুককে (শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলার বাদী, পরে নিহত) পাঠায় এডভোকেট সিরাজুল হকের বাসায়, তাকে দিয়ে তৎকালীন বিমানের এমডি এয়ার কমোডর খসরুর কাছে তদবীর করাতে। এই তদবীর কাজের বিনিময় হিসাবে ১ মিলিয়ন ডলার ঘুস চান সুরাপানরত সিরাজুল হক। ছেলে আনিসুল হকের সামনে এ ঘটনায় ইতস্তত করতে থাকেন তাজুল। তার অবস্থা দেখে সিরাজুল হক বলেন, লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই, আমরা এতে অভ্যস্ত!
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এতোটা দুর্নীতিবাজ, দুশ্চরিত্র আইনমন্ত্রী আর কখনই ছিল না। পাহাড় সমান অপরাধ নিয়ে যাদের কারাগারে থাকার কথা, অথচ তারা চালাচ্ছে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়। চরম দূর্নীতিবাজ এই মন্ত্রীর হাতে সবচেয়ে বেশী ভিকটিম আওয়ামীলীগ ও গোপালগঞ্জ। এখন দেখার সময়, এই দুর্নীতিবাজ দুশ্চরিত্র মন্ত্রী ও সচিবের অপরাধের পাহাড় গড়ে তুলেছেন সারা দেশে এবং

পতিত সরকারের সাবেক আইন মন্ত্রী আনিছুল হকের নির্বাচনী এলাকা আখাউড়া উপজেলায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে আইন মন্ত্রীর মাধ্যমে বিগত ১৫ বছর দেশের শীর্ষস্থানীয় অফিস গুলোতে পোস্টিং নিয়ে নানা অনিয়ম দূর্নীতি ও বদলী বানিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ও প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন মুন্সিগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার মোঃ রমজান খান। বর্তমানে আইন মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পদস্থ দুই কর্মকর্তার সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তিনি নতুন করে বদলী বানিজ্য শুরু করেছেন বলে কয়েক দিন আগে আইন উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এতে দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ আওয়ামী ক্যাডার ও সাব-রেজিস্ট্রার বদলী বানিজ্যের গডফাদার রমজান খানের দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পাদ অর্জন ও বদলী বানিজ্য করে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করা হয়।
বাংলাদেশ নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধিনস্থ কর্মরত কর্মচারীদের পক্ষে দায়ের করা অভিযোগে আরও বলা হয়েছে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার জেলা রেজিস্ট্রার মোঃ রমজান খান দীর্ঘদিন সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকুরী করে দেশের লোভনীয় স্টেশন গুলোতে দু’হাতে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ২০০৪ সালে সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকুরীতে যোগদান করেন। সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্যাডার পরিচয় দিয়ে তার বাড়ী সাবেক আইন মন্ত্রী আনিছুল হকের নির্বাচনী এলাকা আখাউড়া উপজেলায় হবার সুবাদে তিনি আইন মন্ত্রীর মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় অফিস গুলোতে বদলী হয়ে কোটিপতি বনে যান। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন। সেই সুবাদে প্রথম জেল পুলিশ হিসেবে বিভিন্ন জেলে চাকুরী করেছেন। সর্বশেষে যশোর জেলে বন্দীদের অত্যাচার করে টাকা আদায় করার অভিযোগে তার চাকুরী চলে গেলে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন। তারপরই রমজান খানের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। তিনি নরসিংদী সদর, কালামপুর, ফতুল্লা, গুলশান, নেত্রকোনা সদর ও মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত থেকে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি ও বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রার ও জেলা রেজিস্ট্রার বদলী বানিজ্য করে দু’হাতে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। আর ঐ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার শ্যালকের মাধ্যমে লন্ডন, মালয়শিয়া ও দুবাইতে। তার দুবাই, লন্ডন ও মালয়শিয়ায় রয়েছে প্রায় অর্ধ ডজন বাড়ী।
আওয়ামী সরকারের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক দলের ভোল্ট পাল্টে রাতারাতি হয়ে যান বিএনপি নেতা। শুরু করেন তদবীর বানিজ্য ও ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির কমিটি গঠনের দায়িত্ব। আওয়ামী দোসরদের প্রতিষ্ঠিত করতে কয়েকশত আওয়ামী চিহ্নিত কর্মীকে বিএনপিতে যোগদান করিয়ে এবং তাদের রক্ষা করেন। নিজে বিএনপির খাস লোক পরিচয় দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদ থেকে জেলা রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি নিয়ে অবৈধভাবে একই জেলার জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেন তদবীরের মাধ্যমে। যা বিধি বহির্ভূত। ৫ আগষ্টের পর মামলা বানিজ্যও করেন এই সুচতুর জেলা রেজিস্ট্রার রমজান খান। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গত ১৭ বছরে যত বদলী বানিজ্য সংঘটিত হয়েছে তার সিংহভাগই বদলীতে নেপথ্য ভুমিকা রেখেছেন রমজান খান। আইন মন্ত্রনালয়ের দুর্নীতিবাজ যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহার ডানহাত হিসেবে বদলী বানিজ্য পাকাপোক্ত করতেই তিনি গুলশান-১ এর গ্লোরিয়ার জিন্স হোটেলটি বেছে নিয়েছেন। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরেই বসে রমজান খানের সাব-রেজিস্ট্রার ও জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সহকারীদের বদলী বানিজ্যের হাট।
চট্টগ্রাম সদর, গুলশান, শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ, গজারিয়া, রূপগঞ্জ, কাপাশিয়া, শ্রীপুর, গাজীপুর সদর, রাঙ্গুনিয়া, কক্সবাজার সদর, পটিয়া, নোয়াখালী সদর, টাঙ্গাইল সদর, নবাবগঞ্জ, মধুপুর, ঘাটাইল, ত্রিশাল, কান্দিরপাড়, ফুলপুর, খিলগাঁও সহ দেড় শতাধিক সাব-রেজিস্ট্রার বদলী করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন গত ৬ মাসে। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ স্থানীয় দুই জন কর্মকর্তাসহ কতিপয় সাব-রেজিস্ট্রারকে সাথে নিয়ে রমজান খান এক সিন্ডিকেট গঠন করে এ বদলী বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অবলীলাক্রমে। নীলফামারী জেলার জলঢাকা সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লাকে চট্টগ্রাম সদর অথবা রূপগঞ্জে বদলীর কথা বলে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন রমজান খান। পরে তাকে বদলীর আদেশ করান শীতাকুন্ডে। আরও অতিরিক্ত বেশী টাকা পেয়ে রূপগঞ্জ ও চট্টগ্রাম সদরে অন্যদের বদলী করান। পরবর্তীতে আনডিউ বদলীর দোহাই দিয়ে ৬০ লক্ষ টাকা নিয়ে শীতাকুন্ডের বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের বদলীর আদেশ বাতিল করেন। সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার টাকা গুলো মেরে দেন জেলা রেজিস্ট্রার রমজান খান।
বদলী বানিজ্যের গডফাদার রমজান খান এখন মে মাসের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলা থেকে ঢাকা জেলার তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে বদলী হয়ে আসবেন ও ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করবেন বলে ঘোষনা দিয়েছেন। একজন আওয়ামী ক্যাডার ও দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ জেলা রেজিস্ট্রার বিদেশে অর্থ পাচারকারী যদি ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে বদলী হয়ে আসেন তাহলে ঢাকা জেলার ২১টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসই দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। তাদের মতে এমনিতেই রমজান খানের ৩০ জন ব্যক্তিগত দালাল রয়েছে সারাদেশে। যারা প্রতিদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে দলিল ধরে জোর করে সাব-রেজিস্ট্রারদের দলিল করতে বাধ্য করছে। তার মধ্যে যদি রমজান খান ঢাকায় যোগদান করেন তাহলে ঘুষ দুর্নীতি, দলিল বানিজ্য ও অনিয়ম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ বেশী। তাই ঢাকা জেলা সহ সমস্ত রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স জুড়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এখন রমজান আতংক বিরাজ করছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, রমজান খানের রয়েছে গুলশানে নামে বেনামে ৩০টি ফ্ল্যাট ও প্লট বুকিং করা। গুলশান নিকেতনে তিনি বসবাস করছেন স্বপরিবার নিয়ে। আখাউড়াতে রয়েছে তার কয়েকশত একর জমি। ব্যাংকে রয়েছে মোটা অংকের টাকা। দুর্নীতিবাজ ও বদলী বানিজ্যের গডফাদার রমজান খানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক যদি সঠিক ভাবে তদন্ত করে তাহলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে বিস্তারিত আসছে দ্বিতীয় পর্বে

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক প্রথম পর্ব
প্রকাশের সময়: সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ । ১১:৩৩ অপরাহ্ণ